করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতেও সরকার বাজেটের সফল বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর : প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে তাঁর সরকারের দেয়া ২০২০-২১ অর্থ বছরের বাজেটকে কেউ কেউ উচ্চাভিলাষি বললেও সরকার এই বাজেটের সফল বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাজেট বাস্তবায়নে আমরা অতীতে কখনও ব্যর্থ হইনি এবং ভবিষ্যতেও ব্যর্থ হবো না। আমরা কখনও হতাশায় ভুগিনা। আমরা সবসময় একটা লক্ষ্য নির্ধারণ করে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাই।’ প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা আজ একাদশ জাতীয় সংসদের অষ্টম (বাজেট) অধিবেশনে আলোচনায় একথা বলেন। সংসদ নেতা বলেন, ‘অনেকে বলছেন বাজেট একটু বেশি আশাবাদি, বা উচ্চাভিলাষি। একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, সবসময় আমাদের একটা লক্ষ্য থাকতে হবে। আজকে কোভিড-১৯ এর জন্য সবকিছু স্থবির। তবে, আমরা আশাবাদি যে, এ অবস্থা থাকবেনা। এর থেকে উত্তরণ ঘটবে। আজকে যদি হঠাৎ সে অবস্থার উত্তরণ ঘটে যায়, তাহলে আগামিতে আমরা কি করবো, সেটা চিন্তা করেই এই পদক্ষেপটা আমরা নিয়েছি।’ দেশে পর্যাপ্ত চালের মওজুদ রয়েছে এবং ভবিষ্যতে সে সংকটই আসুক না কেন, আওয়ামী লীগ সরকার তা শক্তভাবে মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে বলেও এসময় দেশবাসীকে আশ^স্থ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘কোভিড-১৯-এর প্রভাবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে যে সাময়িক প্রয়োজন উদ্ভূত হয়েছে তা মেটানো এবং অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে যে ক্ষয়-ক্ষতি সৃষ্টি হবে তা পুনরুদ্ধারের কৌশল বিবেচনায় নিয়ে অর্থমন্ত্রী ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ৫ লক্ষ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, এটি আওয়ামী লীগ সরকারের ১৭তম এবং বর্তমান মেয়াদের দ্বিতীয় বাজেট। আর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে সরকার পরিচালনা করেছিলেন সেখানে তিনটি বাজেট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। সে হিসেবে এটি আওয়ামী লীগের ২০তম বাজেট। যেটি আওয়ামী লীগ সরকার এদেশকে উপহার দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘এ বাজেটে অর্থনৈতিক পুনর্গঠন এবং করোনাভাইরাস মোকাবেলায় জীবন ও জীবিকা রক্ষার উপর প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। তাছাড়া, বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য, কৃষি, কর্মসৃজন ও সামাজিক নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।’প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০২১-৪১) অনুমোদন করেছে। যার মাধ্যমে ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে উত্তরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়াও, আমরা আগামী অর্থবছর হতে ৫ বছর মেয়াদি ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবো যার মূল প্রতিপাদ্য হবে দারিদ্র্য ও আয় বৈষম্য কমিয়ে এনে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করা। শেখ হাসিনা বলেন, ‘হয়তো তখন আমরা বেঁচে থাকবো না, কিন্তু কাজ আমরা করে যাচ্ছি, কর্মপন্থা দিয়ে যাচ্ছি। ভবিষ্যতে যারা আসবে তারা যেন এটা অনুসরণ করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যায়।’ প্রধানমন্ত্রী আশংকা ব্যক্ত করেন, বাংলাদেশ বিগত ১২ বছরে গড়ে ১ দশমিক ৪ শতাংশ হারে দারিদ্র্য বিমোচনে সক্ষম হলেও কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাবে চলতি অর্থবছরে এ ধারায় কিছুটা হয়তো ছন্দপতন হতে পারে। তিনি বলেন, এ মহামারির কারণে অর্থনৈতিক কার্যক্রম থমকে যাওয়ার প্রভাবে আমাদের দেশে দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাসকারি মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা অনেকে করেছেন। তিনি বলেন, কিন্তু অত্যন্ত দ্রুততার সাথে আমরা যে সুবিশাল আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করে বাস্তবায়ন শুরু করেছি, তার মাধ্যমে আমরা এ সম্ভাবনাকে অনেকটাই রোধ করতে সক্ষম হবো বলে আমি বিশ^াস করি। ‘চলতি বোরো মৌসুমে সরকার ১১ লক্ষ ৫০ হাজার মেট্রিক টন চাল এবং সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ৮ লক্ষ মেট্রিক টন ধান ক্রয়ের উদ্যোগ নিয়েছে যা গত বোরো মৌসুমের তুলনায় দ্বিগুণ,’ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি দেশবাসীকে এই বলে আশ্বস্ত করতে চাই যে, সামনে যে সংকটই আসুক না কেন, আওয়ামী লীগ সরকার তা শক্তভাবে মোকাবেলা করবে এবং দেশের কোন মানুষকে অভুক্ত থাকতে দেবে না।’ ‘কারণ আমাদের খাদ্য চাহিদা ৩ কোটি ৭৫ লাখ মেট্রিক টন সেখানে উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ৯৯ লাখ মেট্রিক টন। ২৫ লাখ টন উদ্বৃত্ত রয়েছে এবং এই উৎপাদন আমরা অব্যাহত রাখবো। কাজেই আল্লাহর রহমতে আমাদের কোন অসুবিধা হবেনা, ’যোগ করেন তিনি। বিরোধী দলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের এবং সরকার দলীয় জেষ্ঠ্য সাংসদ বেগম মতিয়া চৌধুরীও আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এ সময় স্পিকারের দায়িত্ব পালন করছিলেন। শেখ হাসিনা বলেন, ‘কোভিড-১৯ মোকাবেলা এবং এর অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য আমরা গতানুগতিক বাজেট হতে সরে এসে সরকারের অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে কাঠামোগত পরিবর্তন নিয়ে এসেছি। স্বাস্থ্য খাতকে এবার সর্বাপেক্ষা অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে, এবং করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে এখাতে অতিরিক্ত বরাদ্দ, প্রণোদনা ও ক্ষতিপূরণ ইত্যাদির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘কোভিড-১৯ মোকাবেলায় চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে জনজীবনকে সুরক্ষার লক্ষ্যে ন্যাশনাল প্রিপেয়ার্ডনেস এন্ড রেসপন্স প্ল্যান প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন আরম্ভ করা হয়েছে। কোভিড-১৯ মোকাবেলায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের আওতায় বর্তমানে ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বিশেষ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।’ ‘তাছাড়া কোভিড-১৯ মোকাবেলায় জরুরি চাহিদা মেটানোর জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বাজেট বরাদ্দের দিক দিয়ে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অবস্থান পঞ্চম স্থানে উঠে এসেছে যা গত অর্থবছরে ছিল অষ্টম স্থানে, যোগ করেন তিনি। তিনি বলেন, সরকার করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অত্যন্ত অল্প সময়ে ২ হাজার ডাক্তার ও ৬ হাজার নার্স নিয়োগ দিয়েছে। আরও ২ হাজার ডাক্তার ও ৪ হাজার নার্সের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে, যাদের শীঘ্রই নিয়োগ দেওয়া হবে। হেল্থ টেকনোলজিস্ট, কার্ডিওগ্রাফার এবং ল্যাব এটেনডেন্টের ৩ হাজার নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী করোনাভাইরাস পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে এ পর্যন্ত তার সরকার ঘোষিত প্রায় ১ লক্ষ ৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকার ১৯টি প্রণোদনা প্যাকেজের পুনরোল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের চলমান দুর্নীতি বিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখারও দৃঢ় প্রত্যয় পুণর্ব্যক্ত করেন ।এ সময় তিনি বিরোধী দলীয় উপনেতার বক্তৃতার সঙ্গে একমত পোষণ করে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের সেবাদানকারী চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের এক মাসের খাবারের বিল ২০ কোটি টাকা কি করে হয়, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘এখানে বিরোধী দলের উপনেতা ঠিকই বলেছেন, থাকা-খাওয়া বাবদ মেডিকেল কলেজের হিসেব অনুযায়ী ২০ কোটি টাকা ব্যয় একটু বেশিই মনে হচ্ছে। তবে, এটা আমরা তদন্ত করে দেখছি, এত অস্বাভাবিক কেন হবে। এখানে কোন অনিয়ম হলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’শেখ হাসিনা দৃঢ় কন্ঠে বলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত থাকবে, এক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। দুর্নীতি সমূলে উৎপাটন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। তিনি আরো বলেন,‘দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে এবং আমাদের অর্জনসমূহ সমুন্নত রাখতে সরকার দুর্নীতি বিরোধী লড়াই অব্যাহত রাখবে।
প্রধানমন্ত্রী বিশ^ করোনাভাইরাস পরিস্থিতির সর্বশেষ পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, তাঁর সরকারের যথাযথ এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে বিশে^র অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার নিন্ম পর্যায়ে রয়েছে। যদিও একটি মৃত্যুও তাঁর সরকারের কাম্য নয়। তিনি বলেন, করোনায় আক্রান্তের তুলনায় বাংলাদেশে মৃত্যুর হার ১ দশমিক ২৬ শতাংশ। যেখানে ভারতে ৩ দমমিক ০৮, পাকিস্তানে ২ দশমিক ০৩, যুক্তরাজ্যে ১৪ দশমিক ০৩ এবং যুক্তরাষ্ট্রে ৫ শতাংশ।’ ‘২৮ জুন ২০২০ তারিখ পর্যন্ত সমগ্র বিশ্বে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত মোট রোগীর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১ লক্ষ ২ হাজার জন। তন্মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন ৫ লক্ষ ১ হাজার ৬৪৪ জন। বিশ্বে আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যুর হার ৫ দশমিক ০১ শতাংশ। একই সময়ে বাংলাদেশে ১ লক্ষ ৩৭ হাজার ৭৮৭ জন রোগী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন ১ হাজার ৭৩৮ জন এবং ৫৫ হাজার ৭২৭ জন সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরেছেন’,বলেন তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা চেষ্টাকরে যাচ্ছি কিভাবে মানুষকে সুরক্ষা দেওয়া যায় এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য বার বার জনগণকে আহবান জানাচ্ছি। নিজেকে সুরক্ষিত রাখা এবং অপরকে সুরক্ষিত রাখাটা সকলের দায়িত্ব। তাই আশা করি সকলে নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন।’
প্রধানমন্ত্রী করোনা পরবর্তী সময়ে বিশে^ খাদ্যভাব দেখা দেওয়ার বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ মহলের আশংকার সঙ্গে একমত পোষণ করে সারাদেশে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং ব্যাপক বৃক্ষরোপনের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন।
 ’বাসস