করোনাদিনে বায়োডাইভারসিটির ভাবনা

আমি যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছি তখন বায়োডাইভারসিটি বা বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি বিষয়ে বেশ কিছু কোর্স পড়েছিলাম। বিষয়টি নিয়ে আমার আগ্রহ একটু বেশি ছিল। কারণ অন্যান্য বিষয়ে অনেক কঠিন কঠিন বায়োলজিক্যাল টার্ম পড়তে ও বুঝতে এবং মুখস্থ করতেও বেশ সময় লাগত। কিন্তু বায়োডাইভারসিটি বিষয়ে এরকম টার্মের সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম ছিল, যার কারণে পরীক্ষায় নম্বর তুলনামূলক কম পাব জেনেও আমি বায়োডাইভারসিটি বিষয়ে পরীক্ষায় প্রশ্নের উত্তর দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম।

কিন্তু এই মুহূর্তে যে লেখাটা লিখছি তা আমার শিক্ষাজীবনে প্রাপ্ত ধারণা থেকে কিছুটা ভিন্ন। ভিন্ন এই কারণে বলছি, বায়োডাইভারসিটি নিয়ে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে আমাদের চিন্তাভাবনার যথেষ্ট পরিবর্তন প্রয়োজন। তা না হলে বায়োডাইভারসিটির ক্ষুদ্র অংশ হিসেবে মানবজাতির টিকে থাকাই দুষ্কর হয়ে পড়বে।

আমরা জানি যে, এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবস-২০২০ করোনাভাইরাসের কারণে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতিতে উদযাপিত হয়েছে। এবারের পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য বায়োডাইভারসিটি এবং মূল থিম It's time for nature (সময় এখন প্রকৃতির).

শুরুতেই বলে নেয়া দরকার কেন It's time for nature স্লোগানটি বেছে নেয়া হয়েছে? কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, বিশ্বের অধিকাংশ দেশে স্বাভাবিক প্রকৃতি এখন ধ্বংসের পথে। সাম্প্রতিক অনেক গবেষণায় উঠে এসেছে, বিশ্বের অধিকাংশ বনভূমি এবং বনের জীববৈচিত্র্য মারাত্মক আকারে কমে এসেছে এবং তা অব্যাহত আছে। জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা ইউএনইপি বলছে, খুব শীঘ্রই পৃথিবী থেকে এক মিলিয়ন প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে মানবজাতির সামগ্রিক অস্তিত্ব নিশ্চিত ভাবেই হুমকির মুখে পড়বে ।

আমরা যে খাদ্য গ্রহণ করি, বাতাস থেকে অক্সিজেন নিই, বিশুদ্ধ পানি পান করি এবং সর্বোপরি আমাদের এই পৃথিবী যে বাসযোগ্য আছে তার সবকিছুইর উৎস হচ্ছে এই প্রকৃতি। কোভিড-১৯ এ সৃষ্ট মহামারীর কারণে বর্তমান বিশ্ব যে একটি সামগ্রিকভাবে ব্যতিক্রমী সময়ে রয়েছে তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

এই সময়টি আমাদের একটি বার্তা দিচ্ছে। আর তা হলো, আমাদের নিজেদের ভালো থাকার জন্য প্রকৃতিকে ভালো রাখতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। কঠিন বাস্তবতায় হয়তো আমরা অনেকেই সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করেছি কিন্তু এই বিশ্বের মানুষ এবং এই গ্রহের জন্য প্রকৃতিকে আরও উন্নত করতে আমাদের কণ্ঠস্বরকে এক করতেই হবে। আর এই কারণেই বলা হচ্ছে It's time for nature।

এখন বলতে চাই এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য বায়োডাইভারসিটি বিষয়ে। অতি সংক্ষেপে বায়োডাইভারসিটি বা জীববৈচিত্র্য হলো, পৃথিবীতে জীবনকে সঞ্জীবিত করে এমন জীবের সংখ্যা। ধারণা করা হয়ে থাকে, আমাদের পৃথিবীতে আট মিলিয়ন এর অধিক উদ্ভিদ, প্রাণী, ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়াসহ অন্যান্য প্রজাতি রয়েছে যা একটি নির্দিষ্ট ইকোসিস্টেম যেমন সমুদ্র, বন, পাহাড় ইত্যাদিকে ধারণ করে।

এসকল ইকোসিস্টেম ধ্বংসের কারণে মানব ইতিহাসের অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এক হাজার গুণ বেশি হারে পৃথিবী থেকে বিভিন্ন প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে এবং প্রায় এক মিলিয়ন প্রজাতি বিলুপ্তির মুখোমুখি হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে আমরা ২২ মে, ২০২০ আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস উদযাপন করেছি।

প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দিক থেকে বর্তমানে বিশ্ব সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থান করছে। তার পরেও আমরা আমাদের খাদ্য, ঔষধ, পানি, আশ্রয়, এনার্জি, সর্বোপরি মৌলিক চাহিদা গুলোর জন্য সুস্থ এবং প্রাণবন্ত ইকোসিস্টেমের উপর নির্ভরশীল। জীববৈচিত্র্যের মাধ্যমে নিশ্চিত হয় আমাদের শিল্প এবং জীবিকার ভিত্তি; বৃষ্টিপাত নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয় জলবায়ুর দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন; প্রাকৃতিক বিপর্যয় কমে আসেয; আইলা, সিডর, বুলবুল এবং আমাফানের মত ধ্বংসাত্মক সুপার সাইক্লোনকে প্রশমিত করে।

বায়োডাইভারসিটি বা জীববৈচিত্রের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে আমাদের স্বাস্থ্যের উপর। একটি গবেষণা বলছে মানুষের মধ্য প্রতি চার মাসে একটি নতুন সংক্রামক রোগ দেখা দেয়। এ সমস্ত রোগ গুলির প্রায় ৫ শতাংশ জুনোটিক অর্থাৎ বিভিন্ন প্রাণী থেকে সংক্রমিত হয়। জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা ইউএনইপি এর জীববৈচিত্র্য বিশেষজ্ঞ রবিনসন বলেছেন ‘স্বাস্থ্যকর বাস্তুসংস্থান রোগের বিস্তার থেকে রক্ষা করতে পারে। যেখানে দেশীয় জীববৈচিত্র্য বেশি সেখানে রোগের সংক্রমণের হার কম।

এত প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পরেও এখনো বিশ্বের প্রায় ৪ বিলিয়ন মানুষ প্রাকৃতিক ওষুধের ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে যে আধুনিক ঔষুধগুলো তৈরি হচ্ছে তারও অন্যতম উৎস এই প্রকৃতি। তাছাড়া বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতির অধিকাংশ খাতগুলি প্রকৃতি নির্ভর। খাদ্য ও পানীয়, নির্মাণ এবং কৃষি এই তিনটি বৃহত্তম আর্থিক খাত সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। এই খাতগুলোর জন্য বন এবং সাগর, মহাসাগর থেকে সরাসরি সম্পদ আহরণের প্রয়োজন হয়, যা সাধারণত দূষণমুক্ত মাটি ও পানি, ফসলের পরাগায়ন এবং স্থিতিশীল জলবায়ুর মত বাস্তুতন্ত্রের পরিষেবা ও উপাদানের উপর নির্ভর করে।

বাংলাদেশের মতো কৃষিনির্ভর দেশের অধিকাংশ মানুষই তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভরশীল। যেমন আমাদের দেশের প্রায় ৯০ শতাংশের অধিক মানুষ কৃষিকাজ, মাছ ধরা, বনজ সম্পদ আহরণ বা অন্যান্য প্রকৃতি ভিত্তিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তাদের জীবন ধারণ করে থাকে। এ কারণে আমাদের মতো দেশের জন্য বায়োডাইভারসিটি বা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের প্রকৃতি আজ সংকটে রয়েছে। জীববৈচিত্র্য এবং তার আবাসস্থল ধ্বংস, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাব এবং বিভিন্ন রকমের দূষণের দ্বারা বাংলাদেশের প্রকৃতি আজ চ্যালেঞ্জের মুখে। কয়েক দশক আগেও পরিস্থিতি এরকম ছিল না।

বর্তমানে করোনাভাইরাস থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করা এবং একই সাথে সুস্থ পরিবেশের জন্য যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে তা থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করার জন্য একটি সমন্বিত পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা ও সুস্থ বায়োডাইভারসিটি বা জীববৈচিত্র্যের প্রয়োজন। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য গ্রীন ইকোনোমি রিকভারি প্লান প্রণয়ন করা প্রয়োজন। আমি মনে করি, এ দুটি বিষয়ের যথাযথ সমন্বয়ই পারে আমাদের উজ্জ্বল টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে।

লেখক: শেখ মোজাহীদ ,

পরিদর্শক, পরিবেশ অধিদপ্তর।